মইনুল ইসলাম রাজন: বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে ইউনুস সরকারের আবির্ভাব এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। কাগজে-কলমে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র হলো "সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়"। তবে, এই নীতির পূর্ণ বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব হয়নি। পূর্ববর্তী সরকারগুলোর সময় বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় চীনা ও সৌদি ব্লকের সাথে সুসম্পর্ক গড়তে ব্যর্থতা দেখা দেয়, জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার আমলে সোভিয়েত ও ভারতের সাথে সম্পর্ক ছিল সংকটপূর্ণ। এমনকি খালেদা জিয়ার শাসনামলে ভারত-বাংলাদেশ যুদ্ধের পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনা সরকার পাকিস্তানের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি ভারতের প্রতি নির্ভরতাকে এতটাই বাড়িয়ে তুলেছিলেন যে, অনেকেই এটিকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে মনে করেন।
ইউনুস সরকারের বৈশিষ্ট্য হলো তিনি রাজনীতিতে নবীন এবং তার পূর্বসূরিদের মতো রাজনৈতিকভাবে অভিজ্ঞ নন। তিনি সেই পাঁচজন নোবেল বিজয়ীর একজন যিনি পরবর্তীতে রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন। ইউনুসের মতো একজন নন-রাজনীতিবিদ এর আগে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসেননি। ক্ষমতায় আসার পরপরই ইউনুস সরকার বৈশ্বিক পর্যায়ে স্বীকৃতি লাভ করে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি বড় দেশ থেকে অভিনন্দন বার্তা আসে। এমনকি চীন, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোও এই অনির্বাচিত সরকারকে কোনো আপত্তি ছাড়াই স্বাগত জানিয়েছে। এটি ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় পররাষ্ট্রীয় চ্যালেঞ্জ, যা তারা সফলভাবে উতরে গেছে।
ভারতের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক: ইউনুস সরকার ক্ষমতায় আসার প্রথম ২২ দিনের মধ্যেই ৫০টিরও বেশি দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, যা তার পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারকে স্পষ্ট করে। ভারতের সাথে সম্পর্কের বিষয়েও ইউনুস স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। গ্লোবাল সাউথ সামিটে তার বক্তব্যে তিনি তারুণ্যের শক্তি এবং সম্ভাবনাকে তুলে ধরেন। বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলোচনায় ভারতের সহযোগিতা চান, যা কৌশলগতভাবে ভারতের প্রতি সমালোচনা নয় বরং সহযোগিতার আহ্বান। এভাবে ইউনুস সরকার ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়, যা পূর্ববর্তী সরকারের সময় দেখা যায়নি।
পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কের পুনর্নবীকরণ: পাকিস্তানের সাথে ১৫ বছরের বৈরিতা ঘুচিয়ে ইউনুস সরকার নতুন সম্পর্ক স্থাপনের পথে অগ্রসর হচ্ছে। তারা সার্ক পুনরুদ্ধারের কথা বলছে, যা হাসিনা-মোদি যুগে স্থবির হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান থেকে প্রকাশ্যে অস্ত্র ক্রয় করার মাধ্যমে ভারত এবং মিয়ানমারকে কৌশলগত বার্তা দিচ্ছে ইউনুস সরকার।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ইউনুস সরকার: ইউনুস সরকার আন্তর্জাতিক মঞ্চেও প্রভাব বিস্তার করছে। জাতিসংঘের ICPPED চুক্তিতে সই করার মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক গুম বা খুনের ঘটনার আন্তর্জাতিক নজরদারি নিশ্চিত করেছে। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা এবং ব্যাংকিং খাত সংস্কারে তিনি বিশেষ কমিশন গঠন করতে যাচ্ছেন।
আসিয়ান সদস্যপদের লক্ষ্যে বাংলাদেশ: অঞ্চলভিত্তিক সহযোগিতা বাড়াতে ইউনুস সরকার বাংলাদেশকে আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে আগ্রহী। আসিয়ান হলো এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যা ভারত নির্ভরতা কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তির দ্বার উন্মোচন করতে পারে। বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্য হলে, ভারত থেকে সরে এসে আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হবো, যা আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
তবে আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়ার পথে চ্যালেঞ্জও আছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনেই, এবং ফিলিপাইনের পক্ষ থেকে নিশ্চিত সমর্থন পাওয়া যাবে। বিপরীতে মিয়ানমার এবং ভিয়েতনাম বিরোধিতা করতে পারে। থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, এবং কম্বোডিয়ার সমর্থন পেতে হলে বাংলাদেশের ধৈর্যশীল কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ইউনুস সরকারের পররাষ্ট্রনীতির ধীরগতির কৌশল এই ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হতে পারে। মার্কিন নির্বাচন, পুতিনের সম্ভাব্য পতন, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন আদায় করে বাংলাদেশকে আসিয়ানে যুক্ত করার কূটনৈতিক লড়াইটা হবে ঐতিহাসিক। এই কূটনৈতিক সাফল্য শুধু ভারতের নির্ভরতা কমিয়ে আনবে না, বরং বিশ্ব অর্থনীতির একটি বৃহত্তর অংশে প্রবেশের সুযোগ করে দেবে।
আসিয়ান সদস্যপদ: অনেকের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা, বাংলাদেশ আসিয়ানের সদস্যপদ অর্জন করবে এবং আমরা সহজেই ভিসা ছাড়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভ্রমণ করতে পারবো। আসিয়ান সদস্যপদ প্রাপ্তি বাংলাদেশের মানুষের জন্য এক স্বপ্নের দিন হবে, মুক্তির দিন হবে। ইউনুস সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এই নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। এখন সময়ই বলে দেবে, এই নীতি কতটুকু কার্যকর এবং সফল হবে।